লেখকের কথা

‘জাদু’ এবং ‘বাস্তবতা’ দুটি আলাদা বিষয়। ‘জাদু’র সঙ্গে ‘বাস্তবতা’র বিস্তর ফারাক। কিন্তু এ দুটি বিষয় যখন এক হয়ে যায় তখন এক নতুন সঙ্গমের সৃষ্টি হয়, আর তা হয় জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম। বাস্তবতার সঙ্গে জাদুর বা জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার সংমিশ্রণে বিশ্বাসযোগ্য ধারণা তৈরি নাও হতে পারে। কারণ সাহিত্যে ‘জাদুবাস্তবতা’ এমন এক রীতি যা একই সঙ্গে দ্ব্যর্থক ও বিভ্রান্তিকর। আমার মনে হয় জাদুবাস্তবতা যদি ব্যাখ্যা করা যায় ঠিকঠাক ভাবে তাহলে সেটি আর জাদুবাস্তবতা থাকে না। জাদুকরের দেখানো ম্যাজিকের মতো আমরা যা দেখি তার আড়ালে যে সত্য থাকে তাই হল জাদুবাস্তবতা। আপাতভাবে নেইয়ের ভেতর চরমভাবে আছে। এক অস্বস্তিকর উপস্থিতি। গাব্রিয়াল মার্কেজকে ছেড়ে যদি আমরা বাংলা সাহিত্যেই নজর দিই দেখতে পাব, মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে এর সন্ধান মিলবে। ‘কালকেতু উপাখ্যান’-এ দেখি দেবী চণ্ডী এক-এক সময় এক-এক রকম রূপ বদলাচ্ছে। সোহারাব হোসেনের ‘গাঙবাঘিনী’-তে এই জাদুবাস্তবতাকে আমরা পরতে পরতে দেখি। জাদুবাস্তবতা আসলে একধরনের বাইপোলারিটি বা দ্বৈতসত্তা।

আমরা কি নিজেকেই সবটা জানি বুঝি? ‘আমার ঘরে বসত করে কয় জনা, ও মন জানো না’। না জানি না। সত্যি কেউ জানে না। জানলে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। এই ‘নেই’ আর ‘আছে’-র খেলার মাধুকরীতে আমরা যতই ঝোলা ভর্তি করি না কেন, তা সে ‘ফুটো পাত্রে জল গড়িয়ে পড়া’-র মতোই হয়ে যায়। আমার মনে হয় সারাজীবন ধরে একজন লেখক যেমন একটাই লেখা লিখে যান, তেমন একজন নারী একজন পুরুষকে বা একজন পুরুষ একজন নারীকেই ভালোবেসে যায়। বিভিন্ন আধার, বিভিন্ন স্পন্দনের মাধ্যমে। আসলে কিন্তু সে একজনই। এই একজনের কাছে পৌঁছোতে গিয়ে তাকে পার হতে হয় বিভিন্ন মাধ্যম। একমাত্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই পারে সেই ‘জাদুবাস্তবতা’কে অনুভব করতে। গিরগিটির মতো রং পালটায়, বহুরূপীর মতো সাজ পালটায়, তবুও সে আসলে একজনই। আপাত অসংলগ্নতার ভিতরেই আছে সংলগ্নতার ঘরের চাবি। যে-তালার যে-চাবি তা না পেলে তালা কি খোলে? এও তেমনই।

আমার ‘চন্দ্রাহত’ উপন্যাসটি আমি আমার মতো করে জাদু ও বাস্তবতার মেল-বন্ধন ঘটিয়েছি। এখন বাকিটা পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম।

এ-বইয়ের জন্য আমি ভীষণভাবে সরোজ দরবার ও রোহণ কুদ্দুসের কাছে ঋণী। ওঁরাই আমাকে দিয়ে বহুদিন ধরে লিখতে লিখতে ফেলে রাখা উপন্যাসটি লিখিয়ে নিয়েছেন। আর ঋণী অশোক হালদারের কাছে।

তন্বী হালদার